০৩:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

বন্যায় সব ভেসে গেছে

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৫:১৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ জুন ২০২২
  • / ১০৫৪ বার পড়া হয়েছে

bdopennews

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তার বাড়িতে হাঁটু পানি ছিল। সেটা হতে বেশি সময় লাগেনি। তার নিজের নৌকা চুরি হয়ে যাওয়ায় সে সন্ধ্যায় অন্যের নৌকা সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়।

রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আনোয়ারা তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখেন আনোয়ারা বিছানার চাদরে ভেজা ভাত বিছিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, সকালে দুই ছেলে নৌকা ধার করে

বাড়িতে গিয়েছিলাম. ঘরের পানির নিচ থেকে চাল উদ্ধার করা হয়। এখন এগুলোই সম্পদ।

এই আশ্রয়কেন্দ্রের উঠানে বন্যার পানিতে ভেজা ও কর্দমাক্ত কাপড় ধুচ্ছিলেন নেহেরু বেগম (৫০)। কিশোরী তাইফাও সাহায্য করছিল। নেহেরু বলেন, বন্যা সবকিছু ভেসে গেছে। বাড়িও চলে গেছে। সকালে বাড়ির পাশের গাছের ডালে কাপড় আটকে থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে জামাকাপড়, বিছানাপত্র এবং কিছু বাসনপত্র। পাঁচজনের সংসারে আর কিছু নেই।

তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশাপাশি তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দারুসসালাম মুহাম্মদিয়া মাদ্রাসাকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ে আরও মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিনতলা ভবনের নিচতলার উঠানে নয়টি গরু বেঁধে রাখা হয়েছিল। গরুর পাশে বিভিন্ন বয়সী মানুষ তাদের কাজে ব্যস্ত। লোকজনও দ্বিতীয় তলার কক্ষে আশ্রয় নিয়েছে। তৃতীয় তলায় চারটি কক্ষ থাকলেও দরজা-জানালা নেই। টিন দিয়ে মানুষ বসবাস করছে।

এর মধ্যে একটি কক্ষে থাকেন উত্তর রানীখাই ইউনিয়নের লামা দেস্কি গ্রামের দেবেন্দ্র বিশ্বাস (৬০)। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বন্যায় সব ঘরবাড়ি ও জাল ভেসে গেছে। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। সবাই বন্যার পানি পান করছে। তার টয়লেট সুবিধা নেই। শনিবার আশ্রয়কেন্দ্রে হাঁটু পানি ছিল। গতকাল সেই পানি নেমে গেছে।

সিলেট শহর থেকে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক হয়ে বিমানবন্দর সড়কে গেলে দুই পাশে শুধু পানি দেখা যায়। সদর উপজেলার ছালিয়ার পর গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজার। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যার পানিতে সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক বিচ্ছিন্ন ছিল। পানি কমতে শুরু করায় সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে দুই স্থানে সড়কে এখনো প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে অনেক যানবাহন

সালুটিকর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর কোম্পানীগঞ্জের বারনী এলাকায়। রাস্তার প্রায় ২০০ মিটার পানি প্রবাহিত হয়েছে। তারপরও চলছে যানবাহন। বারনী হাওর হয়ে নৌকায় তেলিখাল গ্রামে যেতে হয়। পথে বেশ কিছু বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। যার সবগুলোই ডুবে গেছে। অনেক বাড়িতে বেড়া ও চালা নেই। এসব বাড়ির বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।

সোলেমান মিয়া (৩৫) নৌকায় করে বারনী গ্রামে বাড়ি দেখতে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বাড়িতে বক্সম্যানের পানি ছিল। পরে তাকে বিছানা ও সোফায় তার জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় করে বের হতে হয়। সালুটিকর বাজারে নৌকায় আশ্রয় নেন চৌদ্দ বাসিন্দা। খাওয়াদাওয়ায় এ সময় বেশি কষ্ট হয়। প্রতিদিন এক কেজি চাল কিনে খেতেন।

তেলিখাল থেকে সড়কপথে প্রায় ৯ কিলোমিটার পর কোম্পানীগঞ্জ থানার বাজার। কিছুদূর গিয়ে রাস্তার দুই পাশে তিনটি ট্রাক পানিতে উল্টে যেতে দেখা গেছে। ব্রিজের ওপর বস্তার মতো করে গরু রাখা হয়েছে। থানা বাজারে রাস্তার ধারে কাঁঠাল কেনা-বেচার চিত্র দেখা গেছে।

থানাবাজার থেকে নৌকায় করে উপজেলা পরিষদ, কোম্পানীগঞ্জ থানা, থানাবাজার টিএন্ডটি রোড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে। থানাবাজারের টিএন্ডটি রোডের সব দোকান তলিয়ে গেছে। থানা চত্বরও প্রায় চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। একই অবস্থা উপজেলা পরিষদেও। এলাকার নলকূপগুলোও তলিয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও আশপাশের এলাকায় এখন নৌকাই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। উপজেলা এখনো বিদ্যুৎবিহীন, মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।

কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কের পাশে বসানো হয়েছে নৌকা ঘাট। সেখান থেকে স্থানীয়দের নৌকায় করে গন্তব্যে আসতে ও যেতে দেখা গেছে। কোম্পানীগঞ্জ বাজার এলাকার সব বাড়ি তলিয়ে গেছে। নিচতলা থেকে ওপরের তলা পর্যন্ত দোতলা থেকে তিনতলা ভবনের বাসিন্দারা বসবাস করছেন।

থানা বাজারের একটি ভবনের নিচে আশ্রয় নিচ্ছিলেন আয়েশা বেগম (৪৮) ও হালিমা বেগম (২৮)। এক সপ্তাহ ধরে তারা গৃহহীন। তারা ভবনে আশ্রয় নিলেও কোনো সাহায্য পাননি বলে জানান।

দুপুর ২টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ থানা থেকে ফেরার পথে কয়েকজন যুবককে একটি নৌকায় বন্যার্তদের জন্য প্রায় ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার নিয়ে যেতে দেখা যায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

বন্যায় সব ভেসে গেছে

আপডেট সময় ০৫:১৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ জুন ২০২২

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তার বাড়িতে হাঁটু পানি ছিল। সেটা হতে বেশি সময় লাগেনি। তার নিজের নৌকা চুরি হয়ে যাওয়ায় সে সন্ধ্যায় অন্যের নৌকা সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়।

রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আনোয়ারা তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখেন আনোয়ারা বিছানার চাদরে ভেজা ভাত বিছিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, সকালে দুই ছেলে নৌকা ধার করে

বাড়িতে গিয়েছিলাম. ঘরের পানির নিচ থেকে চাল উদ্ধার করা হয়। এখন এগুলোই সম্পদ।

এই আশ্রয়কেন্দ্রের উঠানে বন্যার পানিতে ভেজা ও কর্দমাক্ত কাপড় ধুচ্ছিলেন নেহেরু বেগম (৫০)। কিশোরী তাইফাও সাহায্য করছিল। নেহেরু বলেন, বন্যা সবকিছু ভেসে গেছে। বাড়িও চলে গেছে। সকালে বাড়ির পাশের গাছের ডালে কাপড় আটকে থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে জামাকাপড়, বিছানাপত্র এবং কিছু বাসনপত্র। পাঁচজনের সংসারে আর কিছু নেই।

তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশাপাশি তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দারুসসালাম মুহাম্মদিয়া মাদ্রাসাকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ে আরও মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিনতলা ভবনের নিচতলার উঠানে নয়টি গরু বেঁধে রাখা হয়েছিল। গরুর পাশে বিভিন্ন বয়সী মানুষ তাদের কাজে ব্যস্ত। লোকজনও দ্বিতীয় তলার কক্ষে আশ্রয় নিয়েছে। তৃতীয় তলায় চারটি কক্ষ থাকলেও দরজা-জানালা নেই। টিন দিয়ে মানুষ বসবাস করছে।

এর মধ্যে একটি কক্ষে থাকেন উত্তর রানীখাই ইউনিয়নের লামা দেস্কি গ্রামের দেবেন্দ্র বিশ্বাস (৬০)। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বন্যায় সব ঘরবাড়ি ও জাল ভেসে গেছে। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। সবাই বন্যার পানি পান করছে। তার টয়লেট সুবিধা নেই। শনিবার আশ্রয়কেন্দ্রে হাঁটু পানি ছিল। গতকাল সেই পানি নেমে গেছে।

সিলেট শহর থেকে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক হয়ে বিমানবন্দর সড়কে গেলে দুই পাশে শুধু পানি দেখা যায়। সদর উপজেলার ছালিয়ার পর গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজার। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যার পানিতে সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক বিচ্ছিন্ন ছিল। পানি কমতে শুরু করায় সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে দুই স্থানে সড়কে এখনো প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে অনেক যানবাহন

সালুটিকর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর কোম্পানীগঞ্জের বারনী এলাকায়। রাস্তার প্রায় ২০০ মিটার পানি প্রবাহিত হয়েছে। তারপরও চলছে যানবাহন। বারনী হাওর হয়ে নৌকায় তেলিখাল গ্রামে যেতে হয়। পথে বেশ কিছু বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। যার সবগুলোই ডুবে গেছে। অনেক বাড়িতে বেড়া ও চালা নেই। এসব বাড়ির বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।

সোলেমান মিয়া (৩৫) নৌকায় করে বারনী গ্রামে বাড়ি দেখতে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বাড়িতে বক্সম্যানের পানি ছিল। পরে তাকে বিছানা ও সোফায় তার জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় করে বের হতে হয়। সালুটিকর বাজারে নৌকায় আশ্রয় নেন চৌদ্দ বাসিন্দা। খাওয়াদাওয়ায় এ সময় বেশি কষ্ট হয়। প্রতিদিন এক কেজি চাল কিনে খেতেন।

তেলিখাল থেকে সড়কপথে প্রায় ৯ কিলোমিটার পর কোম্পানীগঞ্জ থানার বাজার। কিছুদূর গিয়ে রাস্তার দুই পাশে তিনটি ট্রাক পানিতে উল্টে যেতে দেখা গেছে। ব্রিজের ওপর বস্তার মতো করে গরু রাখা হয়েছে। থানা বাজারে রাস্তার ধারে কাঁঠাল কেনা-বেচার চিত্র দেখা গেছে।

থানাবাজার থেকে নৌকায় করে উপজেলা পরিষদ, কোম্পানীগঞ্জ থানা, থানাবাজার টিএন্ডটি রোড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে। থানাবাজারের টিএন্ডটি রোডের সব দোকান তলিয়ে গেছে। থানা চত্বরও প্রায় চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। একই অবস্থা উপজেলা পরিষদেও। এলাকার নলকূপগুলোও তলিয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও আশপাশের এলাকায় এখন নৌকাই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। উপজেলা এখনো বিদ্যুৎবিহীন, মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।

কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কের পাশে বসানো হয়েছে নৌকা ঘাট। সেখান থেকে স্থানীয়দের নৌকায় করে গন্তব্যে আসতে ও যেতে দেখা গেছে। কোম্পানীগঞ্জ বাজার এলাকার সব বাড়ি তলিয়ে গেছে। নিচতলা থেকে ওপরের তলা পর্যন্ত দোতলা থেকে তিনতলা ভবনের বাসিন্দারা বসবাস করছেন।

থানা বাজারের একটি ভবনের নিচে আশ্রয় নিচ্ছিলেন আয়েশা বেগম (৪৮) ও হালিমা বেগম (২৮)। এক সপ্তাহ ধরে তারা গৃহহীন। তারা ভবনে আশ্রয় নিলেও কোনো সাহায্য পাননি বলে জানান।

দুপুর ২টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ থানা থেকে ফেরার পথে কয়েকজন যুবককে একটি নৌকায় বন্যার্তদের জন্য প্রায় ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার নিয়ে যেতে দেখা যায়।