১০:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

এম-এ মধ্যবিত্ত, এম-এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৪:৩৮:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২
  • / ১৩৮৬ বার পড়া হয়েছে

bdopennews

খেয়েছো মা?”

দাসত্বের প্রথম ঘন্টার শেষে, আমাদের মায়েরা বিরতি দিতেন। একবার তিনি পশ্চিমে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকাতেন। যে গোঙানির মধ্যে লাল হয়ে গেল, সেই আগুনের গোলাটা ততক্ষণে আরও লাল হয়ে যেত—লজ্জায়, কিছু করতে না পেরে। ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত স্নান শেষে দুপুরের আগেই মায়েরা খেতে বসতেন। পাত্রের তলার ভাত আর অবশিষ্ট তরকারির মতন উচ্ছিষ্টের মত তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঠের খোঁপায় শরীর ছিঁড়ে ফেলত। তারপর কোলে মুখ মুছতে মুছতে বলতেন, হ্যাঁ, খেয়েছি, আল্লাহ আমাকে খাওয়ালেন।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাকে খাওয়ান, আমাদেরও খাওয়ান।

2.

মিরপুরে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার বাড়ির পাশে একটি কাঁচাবাজার রয়েছে ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. আমি মাঝে মাঝে সেখানে যাই আমার প্রিয় সবজি কিনতে। অনেক ক্রেতার মধ্যে মধ্যবয়সী কয়েকজন মহিলাকে প্রায়ই দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই আসেন। কারও হাতে টাকা রাখার জন্য ছোট মানিব্যাগ, কারও হাতে টাকা। প্রথম করোনার শেষের দিকে আমি একজন মহিলাকে এক কোণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সকালটা একটু আগেই কেটে গেল। বাজারে তেমন লোক নেই। দেখতে ঠিক সেরকমই। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে মুখ তুলে তাকাল। অনন্ত মায়ের চেহারা। পাতলা সোনার ফ্রেমের চশমা, তার ফাঁক দিয়ে তার দৃষ্টি। কান্না নেই, ভেজা ভেজা। ইতস্তত করে বললাম, আন্টি কোন সমস্যা?

সে হেসেছিল. ষাটের হাসিতে মুক্তা ঝরেছে, বেদনাও। বুক ছুঁয়ে নিরবতা। কাছে এসে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে সমস্যাটি বলতে পারেন? যদি কোন অসুবিধা হয়, কোন প্রয়োজন নেই। ‘ তারপর পৃথিবীর সমস্ত লজ্জায় সে বলল, ‘টাকা হারাও

‘বাজারের টাকা?’

“হ্যাঁ.”

“যেখানে টাকা ছিল?”

তার ডান হাত মেলে। তিনি তার মুঠি উল্টে দেখালেন।

বাকিটা জিজ্ঞেস করতে চাইনি। কিন্তু দিব্যা দেখেন যে তিনি পেনশন বা অন্য কোনোভাবে যে টাকা পান তা ভাগ করে নেন—বাড়ি ভাড়া, ডাক্তার, ওষুধ, বাজার, কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল—আরো কত কী! অনেক সময় অল্প পরিমাণে খেতে হয়। মাঝে মাঝে অতিথি, আমন্ত্রিত শরীর খারাপ-ডাক্তার, টাকা হারিয়ে একদিন। হিসাব আর মেলে না, আগের মত!

এবার ভাঙ্গা সুতির কাপড়ের দিকে তাকালাম। নিশ্চিত ঃ ঈদে কিনলেন নাকি আত্মীয়ের কাছ থেকে উপহার। হাতের চুরি যে তার রঙ হারিয়েছে, নীল রক্তনালী যে উজ্জ্বল আলোতে জেগে উঠেছে। তেলে-লবনের সংসারে জীবন ভাজা হয়েছে, সময় নুন-লবণে ভরে গেছে!

3.

দুদিন আগে বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারের প্রথম দোকানদার জয়নাল। আমি সারি সারি সবজির দিকে তাকিয়ে বললাম, সবজি বিক্রি একটু কম নাকি?

‘ইত্তু না চার, অনেক। যারা এক কেজি কিনতেন এখন আধা কেজি কিনছেন। ‘

4.

মাঝে মাঝে পোস্ট অফিসে যাই। আমার এক বন্ধু সেখানে পোস্টমাস্টার। প্রায়ই কাউন্টারের সামনে ভিড় থাকে। দীর্ঘ ভিড়ের দিন। একজন বৃদ্ধ লোক তার চারপাশের সমস্ত কোলাহল না শুনে, এত নিবিড় মনোযোগ দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে হিসেব করছেন কী হচ্ছে।

আপনি কি গণনা করছেন? ‘

সে মুখ তুলে তাকাল। তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘জীবনের।’ তার হাসি ফুটে উঠল।

‘জীবন!’

“এখন পৃথিবীই জীবন, জীবনই পরিবার।”

‘হিসাব মিলেছে?’

‘না।’ সে থেমে বলল, ‘এখনো মেলাতে হবে। সঞ্চয়পত্রে পরিবারের এই সুদ, সুদ কমানো হয়েছে, অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ‘ সে আবার হাসল। কত দিন আগে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন—‘কান্নার রঙ নেই, তবু এত রঙে আঁকা ছবি আছে।

5.

আমাদের মাথাপিছু আয় কয়েকশ ডলার বেড়েছে। আমাদের রাস্তা নতুন রঙের গাড়ি এবং নতুন আকারের গাড়িতে পূর্ণ। সুউচ্চ ভবন এবং উন্নয়নের বিস্তৃত স্মৃতিস্তম্ভ ধীরে ধীরে আমাদের আকাশকে ঢেকে দিচ্ছে। আমরা আরও ধনী হচ্ছি। আমাদের দেশের ব্যাংকে সেই টাকা রাখার জায়গা নেই, আমরা নীরবে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ‘হোম’ও মালয়েশিয়ায় জিডিপি’ হোম, সিঙ্গাপুরে হোম, কানাডা-আমেরিকাতে বাড়ি, আমাদের অভিজাতদের ‘সেকেন্ড হোম’-এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।

.

দাসত্বের দিন শেষে আমাদের মায়েরা আর অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকায় না। একটি বড় আলু, একটি চকচকে বেগুনের প্রত্যাশায় তাদের চোখ চকচক করছে। কিন্তু সেই গোঙানির মধ্যে যে রোদ লাল হয়ে গেল, যন্ত্রণায় আগের মতোই লাল হয়ে গেল। আমাদের মায়েরা এখনো সেই বিকেলে খেতে বসেন। পৃথিবীর অন্যদের জন্য নুন আর নুন আলাদা, কিন্তু আমাদের মায়েদের জন্য নয় তাদের মুখ সারাদিনের ঘামের নোনতা স্বাদে নোনতা, পিষে খাওয়ার জ্বালায় তাদের স্তন লালায় ভরে যায়।

.

আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ একদিন ক্ষমতার ভালোবাসার মানুষকে পরীক্ষা করব। আমরা যদি এমন একজন মানুষ খুঁজে পাই যে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু মধ্যবিত্তের কথা চিন্তা করে। তাঁকে প্রাপ্তির আনন্দে আমরা সাত দিন খাব না। সাত দিন বেঁচে থাকা খাবারের টাকা দিয়ে দেশের বাকি অংশে তার ভাস্কর্য তৈরি করব!

মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। ‘উচ্চবিত্তরা খেলে জেতার জন্য আর মধ্যবিত্তরা খেলে না হারার জন্য।’ মার্কিন লেখক রবার্ট কিয়োসাকির ভাষায়, এই অপরাজিত খেলা খেলতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা একদিন হেরে যায়। কেউ ম মানে না

নিউজটি শেয়ার করুন

এম-এ মধ্যবিত্ত, এম-এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া

আপডেট সময় ০৪:৩৮:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২

খেয়েছো মা?”

দাসত্বের প্রথম ঘন্টার শেষে, আমাদের মায়েরা বিরতি দিতেন। একবার তিনি পশ্চিমে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকাতেন। যে গোঙানির মধ্যে লাল হয়ে গেল, সেই আগুনের গোলাটা ততক্ষণে আরও লাল হয়ে যেত—লজ্জায়, কিছু করতে না পেরে। ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত স্নান শেষে দুপুরের আগেই মায়েরা খেতে বসতেন। পাত্রের তলার ভাত আর অবশিষ্ট তরকারির মতন উচ্ছিষ্টের মত তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঠের খোঁপায় শরীর ছিঁড়ে ফেলত। তারপর কোলে মুখ মুছতে মুছতে বলতেন, হ্যাঁ, খেয়েছি, আল্লাহ আমাকে খাওয়ালেন।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাকে খাওয়ান, আমাদেরও খাওয়ান।

2.

মিরপুরে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার বাড়ির পাশে একটি কাঁচাবাজার রয়েছে ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. আমি মাঝে মাঝে সেখানে যাই আমার প্রিয় সবজি কিনতে। অনেক ক্রেতার মধ্যে মধ্যবয়সী কয়েকজন মহিলাকে প্রায়ই দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই আসেন। কারও হাতে টাকা রাখার জন্য ছোট মানিব্যাগ, কারও হাতে টাকা। প্রথম করোনার শেষের দিকে আমি একজন মহিলাকে এক কোণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সকালটা একটু আগেই কেটে গেল। বাজারে তেমন লোক নেই। দেখতে ঠিক সেরকমই। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে মুখ তুলে তাকাল। অনন্ত মায়ের চেহারা। পাতলা সোনার ফ্রেমের চশমা, তার ফাঁক দিয়ে তার দৃষ্টি। কান্না নেই, ভেজা ভেজা। ইতস্তত করে বললাম, আন্টি কোন সমস্যা?

সে হেসেছিল. ষাটের হাসিতে মুক্তা ঝরেছে, বেদনাও। বুক ছুঁয়ে নিরবতা। কাছে এসে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে সমস্যাটি বলতে পারেন? যদি কোন অসুবিধা হয়, কোন প্রয়োজন নেই। ‘ তারপর পৃথিবীর সমস্ত লজ্জায় সে বলল, ‘টাকা হারাও

‘বাজারের টাকা?’

“হ্যাঁ.”

“যেখানে টাকা ছিল?”

তার ডান হাত মেলে। তিনি তার মুঠি উল্টে দেখালেন।

বাকিটা জিজ্ঞেস করতে চাইনি। কিন্তু দিব্যা দেখেন যে তিনি পেনশন বা অন্য কোনোভাবে যে টাকা পান তা ভাগ করে নেন—বাড়ি ভাড়া, ডাক্তার, ওষুধ, বাজার, কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল—আরো কত কী! অনেক সময় অল্প পরিমাণে খেতে হয়। মাঝে মাঝে অতিথি, আমন্ত্রিত শরীর খারাপ-ডাক্তার, টাকা হারিয়ে একদিন। হিসাব আর মেলে না, আগের মত!

এবার ভাঙ্গা সুতির কাপড়ের দিকে তাকালাম। নিশ্চিত ঃ ঈদে কিনলেন নাকি আত্মীয়ের কাছ থেকে উপহার। হাতের চুরি যে তার রঙ হারিয়েছে, নীল রক্তনালী যে উজ্জ্বল আলোতে জেগে উঠেছে। তেলে-লবনের সংসারে জীবন ভাজা হয়েছে, সময় নুন-লবণে ভরে গেছে!

3.

দুদিন আগে বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারের প্রথম দোকানদার জয়নাল। আমি সারি সারি সবজির দিকে তাকিয়ে বললাম, সবজি বিক্রি একটু কম নাকি?

‘ইত্তু না চার, অনেক। যারা এক কেজি কিনতেন এখন আধা কেজি কিনছেন। ‘

4.

মাঝে মাঝে পোস্ট অফিসে যাই। আমার এক বন্ধু সেখানে পোস্টমাস্টার। প্রায়ই কাউন্টারের সামনে ভিড় থাকে। দীর্ঘ ভিড়ের দিন। একজন বৃদ্ধ লোক তার চারপাশের সমস্ত কোলাহল না শুনে, এত নিবিড় মনোযোগ দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে হিসেব করছেন কী হচ্ছে।

আপনি কি গণনা করছেন? ‘

সে মুখ তুলে তাকাল। তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘জীবনের।’ তার হাসি ফুটে উঠল।

‘জীবন!’

“এখন পৃথিবীই জীবন, জীবনই পরিবার।”

‘হিসাব মিলেছে?’

‘না।’ সে থেমে বলল, ‘এখনো মেলাতে হবে। সঞ্চয়পত্রে পরিবারের এই সুদ, সুদ কমানো হয়েছে, অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ‘ সে আবার হাসল। কত দিন আগে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন—‘কান্নার রঙ নেই, তবু এত রঙে আঁকা ছবি আছে।

5.

আমাদের মাথাপিছু আয় কয়েকশ ডলার বেড়েছে। আমাদের রাস্তা নতুন রঙের গাড়ি এবং নতুন আকারের গাড়িতে পূর্ণ। সুউচ্চ ভবন এবং উন্নয়নের বিস্তৃত স্মৃতিস্তম্ভ ধীরে ধীরে আমাদের আকাশকে ঢেকে দিচ্ছে। আমরা আরও ধনী হচ্ছি। আমাদের দেশের ব্যাংকে সেই টাকা রাখার জায়গা নেই, আমরা নীরবে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ‘হোম’ও মালয়েশিয়ায় জিডিপি’ হোম, সিঙ্গাপুরে হোম, কানাডা-আমেরিকাতে বাড়ি, আমাদের অভিজাতদের ‘সেকেন্ড হোম’-এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।

.

দাসত্বের দিন শেষে আমাদের মায়েরা আর অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকায় না। একটি বড় আলু, একটি চকচকে বেগুনের প্রত্যাশায় তাদের চোখ চকচক করছে। কিন্তু সেই গোঙানির মধ্যে যে রোদ লাল হয়ে গেল, যন্ত্রণায় আগের মতোই লাল হয়ে গেল। আমাদের মায়েরা এখনো সেই বিকেলে খেতে বসেন। পৃথিবীর অন্যদের জন্য নুন আর নুন আলাদা, কিন্তু আমাদের মায়েদের জন্য নয় তাদের মুখ সারাদিনের ঘামের নোনতা স্বাদে নোনতা, পিষে খাওয়ার জ্বালায় তাদের স্তন লালায় ভরে যায়।

.

আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ একদিন ক্ষমতার ভালোবাসার মানুষকে পরীক্ষা করব। আমরা যদি এমন একজন মানুষ খুঁজে পাই যে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু মধ্যবিত্তের কথা চিন্তা করে। তাঁকে প্রাপ্তির আনন্দে আমরা সাত দিন খাব না। সাত দিন বেঁচে থাকা খাবারের টাকা দিয়ে দেশের বাকি অংশে তার ভাস্কর্য তৈরি করব!

মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। ‘উচ্চবিত্তরা খেলে জেতার জন্য আর মধ্যবিত্তরা খেলে না হারার জন্য।’ মার্কিন লেখক রবার্ট কিয়োসাকির ভাষায়, এই অপরাজিত খেলা খেলতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা একদিন হেরে যায়। কেউ ম মানে না