ইসলামভীতি কীভাবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে
- আপডেট সময় ০৫:৪৪:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জুন ২০২২
- / ৯৫১ বার পড়া হয়েছে
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বিজেপি নেতা ও দলের মুখপাত্র নূপুর শর্মার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ৬ জুন ভারতের মুম্বাইয়ের ভেন্ডি বাজারে বিক্ষোভ মিছিল করেন মুসলিম অধিকারকর্মীরা।
ভারতে ২০২০ সালের এপ্রিলে মুসলিমদের একটি জমায়েত নিয়ে অভিযোগ ওঠে, এ সমাবেশ ভারতে করোনার একটি গুচ্ছ সংক্রমণের জন্য দায়ী। পরে দ্রুতই এ ঘটনা ইসলামভীতিতে মোড় নেয়।
দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের ওই জমায়েতে দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। তাবলিগের এ কার্যক্রম প্রায় শতবছরের পুরোনো। ওই জমায়েতকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার ‘সুপার স্প্রেডার ইভেন্ট’ তথা করোনার সংক্রমণ বিস্তারে বড় প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা বলে আখ্যায়িত করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলামভীতিকে তুলে ধরে এমন সব মিমস ও হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এগুলোর মাধ্যমে তাবলিগের ওই জমায়েতকে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দোষারোপ করা হতে থাকে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও নানা উসকানিমূলক শিরোনামে খবর প্রচার ও প্রকাশ করা শুরু করে। এ রকমই একটি শিরোনাম, ‘করোনা জিহাদ থেকে দেশকে বাঁচাও’।
এ ঘটনায় ভারত লকডাউনের বিধি ভাঙার অভিযোগে প্রায় এক হাজার মুসল্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। এই মুসল্লিরা তাবলিগের ওই জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন। আট মাস পর আদালত আটক সর্বশেষ মুসল্লিকে মুক্তি দেন। আদালত বলেন, সরকারের নির্দেশনায় তাঁদের ‘বিদ্বেষপ্রসূতভাবে’ বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
লকডাউনের বিধি ভাঙার অভিযোগে প্রায় এক হাজার মুসল্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁরা তাবলিগের জমায়েতটিতে যোগ দিয়েছিলেন। আট মাস পর আদালত আটক সর্বশেষ মুসল্লিকে মুক্তি দেন। আদালত বলেন, সরকারের নির্দেশনায় ‘বিদ্বেষপ্রসূতভাবে’ বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাঁদের।
সমবেত হওয়া ওই মুসল্লিদের অধিকাংশ এসেছিলেন ভারতের বাণিজ্যিক অংশীদার ইন্দোনেশিয়া থেকে। বিস্ময়কর না হলেও এ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আঞ্চলিক শীর্ষ বৈঠকে তার অসন্তোষ প্রকাশ করে। আর দেশটির আইনপ্রণেতারা অভিযোগ করেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের কলঙ্কিত করতেই ওই বিতর্ককে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়কে ‘আন্তর্জাতিকীকরণের’ এটি ছিল এক উদাহরণ।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতে যে দুই অবমাননাকর মন্তব্য ঘিরে বর্তমানে কূটনৈতিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে, সেই মন্তব্য করেছেন বিজেপির দুজন শীর্ষস্থানীয় সদস্য। কথিত ইসলামভীতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে মোদির দল বা তাঁর সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়ার ঘটনা এই প্রথম নয়।
শ্রীনাথ রাঘাভান, অধ্যাপক ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়
গত বছরের পুরোটা সময়ে ভারতে ২০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির গেরুয়া পোশাকধারী উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারা ঘৃণামূলক বক্তব্য-বিবৃতির বন্যা বইয়ে দেন। তাঁদের কেউ কেউ হিন্দুদের অস্ত্র তুলে নিতে প্রকাশ্যে প্ররোচিত করেন ও মুসলিম গণহত্যা নিয়ে কথা বলেন। মুসলিমদের মালিকানায় থাকা ব্যবসা বর্জনের দাবিও তোলা হয়।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মুসলমান নারী সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের নিয়ে হিংস্রভাবে ট্রল (হেয় করার উদ্দেশ্যে ঠাট্টা-তামাশা) করা হয়েছে। এমনকি মুসলমান নারীদের অনলাইনে ভুয়া নিলামে তোলার ঘটনা ঘটেছে। এ আগুনে ঘি ঢেলেছে দলকানা সংবাদমাধ্যমগুলো। বিভিন্ন টক শোতে চরম অবস্থানে যেতে অংশগ্রহণকারীদের উসকে দিয়েছে তারা।
এসব ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে মোদি সরকার আগে থেকেই তার করে রাখা হিসাব–নিকাশ অনুযায়ী চুপ থেকেছে, না হয় ধীরগতিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কিংবা দায়ী করা হয়েছে (বিজেপির) মূলধারার বাইরের লোকজনকে।
সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ অনলাইনে মুসলমানদের কলঙ্কিত করতে ভারতের সাধারণ হিন্দুদের উৎসাহ জুগিয়েছে। পরিণতিও অবশ্য ভোগ করতে হয়েছে। ২০১৮ সালে টুইটারে ইসলামবিরোধী পোস্ট করায় দুবাইয়ের একটি হোটেল থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনপ্রিয় এক রাঁধুনিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপর ২০২০ সালে এসে টুইটারে তাবলিগ জামাতবিরোধী পোস্ট করা শুরু করেন দুবাইয়ে বসবাসকারী ভারতীয়রা। তখন দুবাইয়ের এক নারী ব্যবসায়ী টুইট করে বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতে কেউ প্রকাশ্যে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণ করলে, তাঁকে জরিমানা করা হবে। পাশাপাশি এখান থেকে চলে যেতে হবে।’ ওই নারীর ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
এবারও ভারতকে প্রচণ্ড পাল্টা ধাক্কার মুখে পড়তে হয়েছে। এটা অবাক করে দেওয়ার মতো কিছু নয়। সৌদি আরব, ইরান, কাতারসহ অন্তত ১৫টি দেশ ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক তামিম আহমদের ভাষ্যমতে, মহানবী (সা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য স্পষ্টভাবে সীমা অতিক্রম করেছে।
মহানবী (সা.)–কে নিয়ে মন্তব্যের পর নূপুর শর্মাকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার। ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিশারদ প্রতাপ ভানু মেহতার মতে, ‘এই ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, সংখ্যালঘুদের এভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো আর সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় তাঁদের প্রতি ঘৃণাভরা মন্তব্য করা সারা বিশ্বে ভারতের যে সুখ্যাতি, সেটির ওপর প্রভাব ফেলবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলামভীতিকে তুলে ধরে এমন সব মিমস ও হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এগুলোর মাধ্যমে তাবলিগের ওই জমায়েতকে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দোষারোপ করা হতে থাকে।
আর যাই হোক, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা পুরোনো ও গভীর। প্রায় ৮৫ লাখ ভারতীয় প্রবাসী গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ছয়টি দেশে কাজ করেন। এই সংখ্যাটা দেশগুলোতে কাজ করা প্রবাসী পাকিস্তানিদের দ্বিগুণের বেশি।
ছয়টি দেশের প্রতিটিতে আলাদাভাবে ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় প্রবাসী কমিউনিটি রয়েছে। এই ভারতীয়রা নিজ দেশে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। ওই অর্থের ওপর নির্ভর করে তাঁদের পরিবারের ৪ কোটি সদস্য। তাঁদের অনেকেরই বসবাস বিজেপিশাসিত উত্তর প্রদেশের মতো দরিদ্রতম রাজ্যগুলোতে।
এ ছাড়া ভারত ও জিসিসির মধ্যে প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। আর সৌদি আরবের পর ইরাক থেকে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করে ভারত। এমনকি ভারতের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশের বেশি আসে কাতার থেকে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ভারতের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘাভান বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে ভারতীয়দের অরাজনৈতিক, আইন মান্যকারী ও দক্ষ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের সাবেক কূটনীতিক তালমিজ আহমদ। তাঁর ভাষায়, ‘ভারতে যদি এমন আক্রমণাত্মক কথাবার্তা চলতে থাকে, তাহলে উপসাগরীয় দেশগুলোর নিয়োগকর্তারা ভারতীয়দের চাকরি দেওয়া বন্ধ করবেন।’
মহানবী (সা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের ঘটনায় মোদি সরকার দেরিতে হলেও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘাভান বলেন, ‘দেশের ভেতরের ও বিদেশি রাজনীতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ভারত সরকার কী চায়, তা ঠিক করে নিতে হবে। তারা কি আসলেই নিজেদের একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে নিয়ে যেতে চায়?’